গত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে কতটা লুটপাট চালিয়েছে এস আলম গ্রুপ, তার খণ্ডচিত্র উঠে এসেছে ইউনিয়ন ব্যাংকে পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তদন্ত প্রতিবেদনে।
অনুমোদন ছাড়াই ঋণ নেওয়া, সফটওয়্যারে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া জামানত দিয়ে ঋণ নেওয়া, জমির মূল্য ২ হাজার ৭০০ শতাংশ বেশি দেখিয়ে ঋণ নেওয়া-কী হয়নি ব্যাংকটিতে! এসব প্রক্রিয়ায় মাত্র ৩৩৪ কোটি টাকার জামানত দিয়ে ব্যাংকটি থেকে ১৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকটি বর্তমানে মার্জার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে যার আনুষ্ঠানিকা শুরু করতে বুধবার এর পর্ষদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইউনিয়ন ব্যাংকের আদলে মাত্র চারটি ব্যাংক থেকেই এস আলম গ্রুপ নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। বিষয়টি আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের হিসাবে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ঋণগ্রহণকারী গ্রুপ এস আলম মোট ১১টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। তালিকায় আছে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানও।
বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের হিসাবে, চট্টগ্রামভিত্তিক এই ব্যবসায়ী গ্রুপটি ঋণের নামে সবচেয়ে বেশি লুট করেছে ইসলামী ব্যাংক থেকে। এর পরিমাণ ১ লাখ ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। পাশাপাশি ৪৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা নিয়েছে তৃতীয় প্রজন্মের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে। চতুর্থ প্রজন্মের গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বের করে নিয়েছে ১৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
আর ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে নিয়েছে ২৩ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত মোট ঋণের ৮৩ শতাংশ। বিএফআইইউর এই হিসাবের সঙ্গে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবের।
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট কত টাকা গ্রুপটি ঋণের নামে নিয়েছে এবং কত পাচার করেছে, গত এক বছরের বেশি সময়েও এর পূর্ণাঙ্গ হিসাব বের করতে পারেনি সরকারের কোনো সংস্থা। তবে চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দাবি করেছিলেন, গ্রুপটি কমপক্ষে ১ দশমিক ২৫ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘এস আলম গ্রুপ শত শত কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ঋণ নিয়েছে। প্রতিনিয়তই এমন নতুন নতুন ঋণ আবিষ্কৃত হচ্ছে। ব্যাংক খাতে তাদের লুটপাটের মাত্রা এতটাই বেশি যে, আমরা আসলে হিসাবের শেষ পর্যন্ত যেতে পারছি না।’
বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দানবে রূপ নেওয়া গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউনিয়ন ব্যাংকের ক্ষত চিহ্নিত করতে বেশ কয়েকটি পরিদর্শন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে ইসলামী ধারার এই ব্যাংকটির খেলাপির হার বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৯৮ শতাংশ যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ।
ব্যাংকটিতে পারিদর্শনে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ১৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা ঋণের তথ্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন, যা স্পষ্ট ব্যাংক লুটের পর্যায়ে পড়ে। এই বিপুল ঋণের বিপরীতে জামানত আছে মাত্র ৩৩৪ কোটি টাকার। এই টাকার প্রায় পুরোটাই এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নামে-বেনামে তুলে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের টাস্কফোর্স দল তদন্তে দেখতে পেয়েছে, কোনো প্রকার অনুমোদন ছাড়াই ১৯টি শাখা থেকে ৪৮ জন গ্রাহককে ২ হাজার ২৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। একই সঙ্গে বিভিন্ন শাখার ২২২ জন গ্রাহককে মঞ্জুরি সীমার অতিরিক্ত ৪ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ১৯টি শাখার ৫০ জন গ্রাহককে বিভিন্ন ফিন্যান্সিয়াল ইন্সট্রুমেন্ট লিয়েন দেখিয়ে ২ হাজার ১২৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
পরিদর্শন দল দেখতে পেয়েছে, ব্যাংকটির কোর ব্যাংকিং সল্যুশন সফটওয়ার (সিবিএস) ম্যানিপুলেট করে ভুয়া ফিন্যান্সিয়াল ইন্সট্রুমেন্ট লিয়েন করা হয়েছে। ঋণ বিতরণের জন্য ২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার ইন্সট্রুমেন্ট লিয়েন দেখানো হলেও অস্তিত্ব পাওয়া গেছে মাত্র ৭৯ কোটি টাকার ইন্সট্রুমেন্ট।
এসব অনিয়মের সঙ্গে শাখাগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সহ প্রধান কার্যালয়ের বিনিয়োগ ও ঋণ বিভাগের প্রধান এবং এই বিভাগের লিমিট লোডিং কর্মকর্তার সরাসরি জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
অনুসন্ধান প্রতিবেদন অনুযায়ী, জামানত নেওয়া জমির মূল্য ২ হাজার ৭০০ শতাংশ বেশি দেখিয়ে ২০টি শাখার ১০১ গ্রাহককে ঋণ দিয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক। ২৫৫ কোটি টাকার জমির মূল্য ৬ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে।
এই অনিয়মের সঙ্গে ওই শাখাগুলোর ব্যবস্থাপক, শাখার ইনভেস্টমেন্ট ইনচার্জ, অপারেশন ম্যানেজার ও ভ্যালুয়েশন কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জমির অতি মূল্যায়ন করে কত টাকা ঋণ নিয়েছে তা বাংলাদেশ ব্যাকের প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও ইউনিয়ন ব্যাংক সূত্র সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার কথা জানিয়েছে।
আইন অনুযায়ী, এসব ঋণের ক্ষেত্রে শতভাগ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত জামানত থাকতে হয়। এসবের তোয়াক্কা না করেই দুই শতাংশেরও কম (১ দশমিক ৯) জামানত দিয়ে টাকা বের করে নিয়েছে গ্রুপটি। যে কারণে এই ঋণের ৯৮ শতাংশই উদ্ধারের কোনো সুযোগ নেই।
তদন্তে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, এসব ঋণের সঙ্গে এস আলম গ্রুপ ও এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলার সম্পৃক্ততা মিলেছে। এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্য ব্যাংকগুলোর মতো ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে এসব ঋণ বের করতে বিভিন্ন কাগুজে কোম্পানি ব্যবহার করা হয়েছে।
বেশিরভাগ কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। এমনকি এসব কোম্পানি আরজেএসসিতে নিবন্ধনও করা হয়নি।
ইউনিয়ন ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, “এই গ্রুপটি হরিলুটের মতো যখন খুশি তখন হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছে।”
ব্যাংকারদের সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের অফিসে একটি পৃথক বিভাগই ছিল এমন ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স তৈরি করার জন্য। তারা বিভিন্ন ব্যক্তির এনআইডি সংগ্রহ করে এমন ভুয়া ডকুমেন্টস তৈরি করতো।
এক্ষেত্রে গ্রুপটির মধ্য থেকে নিম্ন সারির কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের ব্যবহার করা হয়েছে বেশি। চাকরি দেওয়ার সময় এদের জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতো গ্রুপটি।
চলতি বছরের ৬ মার্চ ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দিয়ে এসব অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ।
বিষয়টি প্রসঙ্গে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘জড়িত কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধেই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধেও প্রক্রিয়া চলমান রয়েছ।’
ব্যাংকগুলোতে এমন নগ্ন লুটপাট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘এস আলম গ্রুপ ব্যাংকগুলো থেকে যেভাবে ঋণ বের করে নিয়েছে তা নজিরবিহীন। এসব ঋণ বের করতে যারাই সহযোগিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
আর তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশের আদালত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্ণ সহযোগিতা করবে, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে আরও ৮ ব্যাংকের সঙ্গে ২০১২ সালে অনুমোদন পায় ইউনিয়ন ব্যাংক। অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক শুরুতে বিরোধিতা করলেও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।
ইউনিয়ন ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুর নাম থাকলেও প্রথম দিন থেকেই ব্যাংকটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্টা করে এস আলম গ্রুপ।
২০১৩ সালে যখন ব্যাংকটি কার্যক্রম শুরু করে তখন পরিচালন পর্ষদের চেয়ারম্যান হন এস আলমের আপন ছোট ভাই শহীদুল আলম। এরপর থেকেই ব্যাংকটির পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ ছিল এই পরিবারের হাতেই। গত ২৭ আগস্ট ব্যাংকটির পর্ষদ বিলুপ্ত করে ব্যাংকার, শিক্ষক ও হিসাববিদদের নিয়ে পাঁচ সদস্যের নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নতুন পর্ষদ গঠনের পরও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থেকে নিয়মিত অফিস ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এস আলমের ‘পিএস-টু’ হিসেবে পরিচিত এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী। আগস্ট বিপ্লবের দুই মাসের বেশি সময় পর গত বছরের ১০ অক্টোবর তিনি নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে যান। ওইদিন সকালে গোয়েন্দ সংস্থার পরিচয়ে কিছু লোক তার সঙ্গে দেখা করেছিল বলে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইউনিয়ন ব্যাংকের মোট ১১৪টি শাখা রয়েছে। আমানত ১৭ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা হলেও ঋণ বিতরণ করেছ ২৮ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২৬ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। আরও কিছু ঋণ খেলাপি হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে আইপিওর মাধ্যমে ৪২৮ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে ইউনিয়ন। দশ টাকা অভিহিত মূল্যের এই ব্যাংকের শেয়ার ২৮ আগস্টে ২ দশমিক ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
যেভাবে সাত ব্যাংকের দখল নেয় এস আলম
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে একে একে ছয়টি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক আগে থেকেই গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান ছিলেন গ্রুপটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ। ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ব্যাংক ২০১৩ সালে অনুমোদনের পরই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী। এরপরে ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রণ নেন ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আল আরাফার। সরকার পতনের অল্পদিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতায় সর্বশেষ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল ন্যাশনাল ব্যাংকের।
ব্যাংকের পাশাপাশি দুটি অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠনেরও নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল গ্রুপটি। এসব প্রতিষ্ঠান দখলে কোনো প্রশ্নের মুখে না পড়েই ব্যাংক কোম্পানি আইন ভেঙেছিলেন এস আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো থেকে তারা বিশেষ অনুমোদন পেয়েছিলেন অবলীলায়।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় দেশের সর্ববৃহৎ ‘অলিগার্ক’ গ্রুপটি। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ব্যাংকে একটি পরিবারের শেয়ার ধারণের সীমা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হলেও ইসলামী ব্যাংকে এই পরিবারের ৮২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। আদালতের নির্দেশে এসব শেয়ার অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এখান থেকে কিছু শেয়ার বিক্রি করে গ্রুপটির থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের কথা বলেছিলেন গভর্নর। তবে গত নভেম্বরের এই বক্তব্য এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, সামরিকি গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর মদদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির সহযোগিতায় ইসলামী ব্যাংকের মতো অন্য ব্যাংকগুলোতেও নিয়ন্ত্রণ নেয় সাইফুল আলম মাসুদ। বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমের সমালোচনা অগ্রাহ্য করে এই পরিবারকে হাত খুলে সহযোগিতা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের প্রয়োজনে নিয়ম শিথিল করা থেকে নতুন নিয়ম তৈরি করা। কোনো কিছুতেই অমত ছিল না আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির।
সাইফুল আলমের নিকটাত্মীয় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ব্যাংকের পর্ষদে ছিল। বাদ যায়নি দূরের আত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ট পরিচিতজন। অথচ ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের পরিবারের সদস্য কিংবা প্রতিষ্ঠানের একটি ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ার থাকার পর অন্য ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ার ধারনের সুযোগ নেই। এরপরও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য শেয়ার থাকার পরও ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক ও ২০১৮ সালে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখলে নেন এস আলম।
আইনে আরও বলা রয়েছে, একটি পরিবার ও তাদের প্রতিষ্ঠানের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকতে পারবে না এবং পরিবারের তিন জনের বেশি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ শেয়ার ছাড়াও ইউনিয়ন ব্যাংকের ৭০ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামীর ৩০ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটির ২৮ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২২ শতাংশ ও আল আরাফার ৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিয়েছিল গ্রুপটি। পাশাপাশি আভিভা ফাইন্যান্সের ৭০ শতাংশ ও নর্দার্ন ইনস্যুরেন্সের ৫ শতাংশের মালিকানা এই পরিবারের।
ব্যাংক লুটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতা প্রসঙ্গে সংস্থাটির মুখপাত্র মো. আরিফে হোসেন খান টাইমস অব বাংলাদেশকে বলেন, ‘ওই সময়ে দেশে দানবের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মুখ বুজে কাজ করে যাওয়া কিংবা স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে নিজেরাও কিছু সুবিধা লাভ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।