বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ই-স্পোর্টসে পদযাত্রা শুরু করলো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বাফুফে ভবনে আয়োজিত এক প্রেস কনফারেন্সে এ ঘোষণা দেন বাফুফের সভাপতি জনাব তাবিথ আউয়াল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাফুফের সদস্য জনাব ইমতিয়াজ হামিদ সবুজ, স্টেলার ডিজিটাল লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার জনাব ফায়াজ তাহের, লেভেল সেভেন লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মোহাম্মদ আলিউর রহমান সোহান এবং ব্লাডম্যানের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জনাব মো. শাহরিয়ার হাসান জিসান।
অনুষ্ঠানে বক্তারা ই-স্পোর্টসকে ঘিরে নানা দিক তুলে ধরেন। লেভেল ৭ লিমিটেডের সিইও সোহান স্পষ্ট করেন কেন ই-স্পোর্টস আর গেমিং একই জিনিস নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন গেম খেলেছি, কখনও আড্ডা, কখনও বিনোদনের জন্য। এটিই গেমিং। কিন্তু ই-স্পোর্টস হলো আরও বড় একটি ক্ষেত্র, যেখানে কেউ চাইলে পেশাদার গেমার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে পারে এবং জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। গেমিংয়ে সময় দিতে হয় কম এবং আয়ের সুযোগও সীমিত। কিন্তু ই-স্পোর্টসে নিয়মিত অনুশীলন ও সময় দিতে হয় এবং সেখানেই তৈরি হয় আয়ের বিস্তৃত সুযোগ। ই-স্পোর্টসের মাধ্যমে একজন গেমার কেবল নিজের জন্য নয়, দেশের জন্যও বৈশ্বিক পর্যায়ে সাফল্য এনে দিতে পারে।’
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি তাবিথ আউয়াল বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে আমরা নতুন কিছু নিয়ে আসি। এবার নির্বাচিত কমিটির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ই-স্পোর্টসে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করছি। ফুটবলই থাকবে আমাদের মূল কাজের ক্ষেত্র, তবে ই-স্পোর্টসকে ব্যবহার করে ফুটবলকে বৈশ্বিকভাবে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। আমাদের পরিকল্পনায় থাকবে তিনটি ক্ষেত্র, রকেট লিগ, মোবাইলে ফুটবল গেম এবং কনসোল ভিত্তিক ফুটবল গেম।’
তিনি আরও বলেন, ‘ই-স্পোর্টস ইতিমধ্যে এশিয়ায় শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। অন্য দেশগুলো যেভাবে ফুটবলকে ই-স্পোর্টসের মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছে, আমরা চাই বাংলাদেশও সেই যাত্রার অংশ হোক। ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে আছি। ভারতের জনসংখ্যার কারণে তারা এগিয়ে থাকলেও আমরা চাই সাফল্যের হার দিয়ে চীন ও ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে। আমাদের বিশ্বাস, বাংলাদেশে এমন প্রতিভাবান গেমার আছে যারা লাল-সবুজের জার্সি গায়ে বিশ্বমঞ্চে দেশের নাম উজ্জ্বল করবে।’
এ লক্ষ্যেই শুরু হচ্ছে রোড টু রিয়াদ। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন ধাপে আয়োজন করা হবে ট্রায়াল। প্রথম ধাপ ৫ সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয় ধাপ ২০ সেপ্টেম্বর এবং তৃতীয় ধাপ ৫ অক্টোবর। এখান থেকে নির্বাচিত খেলোয়াড়দের পাঠানো হবে এশিয়া-ইস্ট এবং ওশানিয়া অনলাইন রিজিওনাল কম্পিটিশনে, যা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা অক্টোবরের মাঝামাঝি।
তাবিথ আউয়াল আরও যোগ করেন, ‘আমার সন্তানদের আমি সচরাচর ফোন থেকে দূরে রাখি। কিন্তু ই-স্পোর্টস যেভাবে নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে, এখন আমি সবাইকে বলতে চাই, আপনারা সন্তানদের গেম খেলাকে শুধু সময় নষ্ট হিসেবে দেখবেন না। সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে এর মাধ্যমেই তারা দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। এখানে ১৬ বছরের বেশি যেকোনো খেলোয়াড় অংশ নিতে পারবে। আমার নিজেরও খেলতে ইচ্ছে করছে, তবে যেহেতু আমি সন্তানদের আগে বকাঝকা করেছি, তাই আর খেলা সম্ভব নয়,’ বলে তিনি মুচকি হেসে মন্তব্য করেন।
ফিফা ই-ওয়ার্ল্ড কাপকে ঘিরে বিশ্বের নানা প্রেক্ষাপটও অনুষ্ঠানে উঠে আসে। জানা যায়, ই-স্পোর্টস এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি খেলা। ফিফার উদ্যোগে ২০০৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতা আজ মর্যাদাপূর্ণ বিশ্বকাপ আসরে রূপ নিয়েছে। শুরুতে শুধু কনসোলে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে মোবাইলসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে খেলা যায়। ঠিক ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের মতোই এখানে প্রতিযোগীরা তাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
গত বছর সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত ফিফা ই-ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২৪ এ অংশ নিয়েছিল বিশ্বের সেরা সব খেলোয়াড়। ছিল লাখো ডলারের প্রাইজ পুল। একই ধারাবাহিকতায় এবারও রিয়াদে অনুষ্ঠিত হবে ফিফা ই-ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২৫। পার্থক্য হলো এবার সুযোগ থাকছে বাংলাদেশেরও। ই-স্পোর্টসকে সরকারিভাবে ক্রীড়া স্বীকৃতি দেওয়ার পর এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য আনন্দের সংবাদ।
এই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য বাফুফে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে বাফুফে ই-গেমস ন্যাশনাল কোয়ালিফায়ার্স, রোড টু রিয়াদ ২০২৫। এটি ফিফা ই-ওয়ার্ল্ড কাপের জাতীয় নমিনেশন পর্ব হিসেবে কাজ করবে। প্রতিযোগিতা হবে অনলাইন ও অফলাইন উভয়ভাবে। তিনটি গেমে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকছে, ই-ফুটবল কনসোল, ই-ফুটবল মোবাইল এবং রকেট লিগ। এখান থেকে বিজয়ী খেলোয়াড় বা দল প্রতিনিধিত্ব করবে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশের এই ন্যাশনাল কোয়ালিফায়ারসের জন্য রেজিস্ট্রেশন শুরু হবে বিভিন্ন তারিখে। ই-ফুটবল কনসোল সেগমেন্টে নিবন্ধন চলবে ২৪ থেকে ২৯ আগস্ট। এর খেলা হবে ৫ বা ৬ সেপ্টেম্বর। ই-ফুটবল মোবাইল সেগমেন্টে নিবন্ধন চলবে ২৫ থেকে ৩১ আগস্ট এবং এর খেলা হবে ২০ সেপ্টেম্বর। রকেট লিগ সেগমেন্টে নিবন্ধন চলবে ২৫ আগস্ট থেকে ১২ সেপ্টেম্বর এবং এর খেলা হবে ৪ অক্টোবর। প্রতিটি সেগমেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফাইনাল পর্যন্ত ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হবে অফলাইনে, অর্থাৎ ল্যানভিত্তিকভাবে। ভেন্যুর বিস্তারিত তথ্য পরে জানিয়ে দেওয়া হবে।
এভাবেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এগিয়ে নিচ্ছে ই-স্পোর্টসে দেশের নতুন অধ্যায়। হয়তো মাঠে ফুটবল খেলতে না পারা কোনো তরুণ, কিংবা শারীরিক সীমাবদ্ধতায় থাকা ফুটবলপ্রেমী, তার মোবাইল বা কনসোল ব্যবহার করেই বিশ্বমঞ্চে লাল-সবুজ পতাকা উড়াতে পারবেন। ঠিক সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথেই শুরু হলো রোড টু রিয়াদ ২০২৫।