‘আমি এখন কী করি? কোন পথে হাঁটি?’

টাইমস রিপোর্ট
6 Min Read
Highlights
  • ‘অথচ এখন আমার দৈনন্দিন জীবন শুরু হয় ওষুধ খেয়ে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিয়ে এবং ওষুধ কেনার টাকার চিন্তায়’

সাংবাদিক-কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকার জীবনের শেষ লেখা ‘খোলা চিঠিতে’ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং-এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রেসবিভাগ তো মনখোলা নয়। মিডিয়ার যারা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন তারা সবাই আতঙ্কে থাকেন সব সময়। কখন না কোন খবর বা লেখার জন্য ফোন আসে। তুলে নিতে হয় লেখা বা খবর!’

তার প্রশ্ন, ‘আমি এখন কী করি? কোন পথে হাঁটি?’

বৃহস্পতিবার বাড়ি থেকে বের হয় ‘নিখোঁজ’ সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের মরহেদ শুক্রবার বিকালে মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। এর আগে নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ইমেইলে পাঠানো ‘খোলা চিঠিতে’ তিনি এসব কথা বলেন। ফুটনোটে লেখাটিকে তিনি তার ‘জীবনের শেষ লেখা’ উল্লেখ করেন।

কয়েকবছর ধরে ছিলেন হতাশায়

বিডিনিউজের অ্যাসাইন্টমেন্ট এডিটর রাজিব নূর টাইমস অব বাংলাদেশকে জানান, বিভুরঞ্জনের ওই লেখাটি তারা বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৯টায় পান। লেখাটি মতামত বিভাগের প্রকাশের আগে তারা আশায় ছিলেন বিভুরঞ্জন ফিরে আসবেন, এ কারণে তখনই লেখাটি প্রকাশ করা হয়নি। এটি প্রকাশিত হয়েছে তার মরদেহ উদ্ধারের পর, শুক্রবার বিকাল ৫টা ২৩ মিনিটে।

রাজিব নূর বলেন, ‘বিভুদার লেখার শেষ লাইনটি পড়েই (“জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন”) আমি তার ছোটভাই, আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চিররঞ্জন সরকারকে টেলিফোন করি, তাকে জানাই, ওই লেখার শেষ বাক্যটি ভাল লাগছে না।’

‘চিররঞ্জন তার বাসায় কথা বলে জানায়, বিভুদা সেদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন, অফিসে যাননি, মোবাইল ফোনটিও রেখে গেছেন।’

‘চিররঞ্জন এ-ও জানায়, তার ভাই গত কয়েক বছর ধরে নানা রকম হতাশায় ভুগছিলেন’, যোগ করেন তিনি।

সাংবাদিক রাজিব নূর বলেন, ‘সব মিলিয়ে একদিন অপেক্ষার পর তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর আমরা লেখাটি প্রকাশ করি।’

বিভুরঞ্জন সরকার তার ওই খোলা চিঠিতে দীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনের নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ক্ষোভ ও হতাশার কথা তুলে ধরেন। এইচএম এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রসঙ্গও টানেন। পাশাপাশি তীব্র সমালোচনা করেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের।

প্রশ্নবিদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকার

তিনি বলেন, ‘গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর গণমাধ্যমের অবস্থা আরও কাহিল হয়েছে। মন খুলে সমালোচনা করার কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। কিন্তু তার প্রেসবিভাগ তো মনখোলা নয়। মিডিয়ার যারা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন তারা সবাই আতঙ্কে থাকেন সব সময়। কখন না কোন খবর বা লেখার জন্য ফোন আসে। তুলে নিতে হয় লেখা বা খবর!’

‘এর মধ্যে আমার একটি লেখার জন্য “আজকের পত্রিকা”র অনলাইন বিভাগকে লালচোখ দেখানো হয়েছে। মাজহারুল ইসলাম বাবলার একটি লেখার জন্যও চোটপাট করা হয়েছে। আপত্তিকর কি লিখেছেন বাবলা? লিখেছেন, সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে সামরিক হেলিকপ্টারে দিল্লি পাঠিয়েছে। আর শুধু পুলিশের গুলিতে নয়, মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে জঙ্গিরাও মানুষ হত্যা করেছে। এখানে অসত্য তথ্য কোথায়? শেখ হাসিনা কি হেলিকপ্টার ভাড়া করে গোপনে পালিয়েছেন? হাসিনার পুলিশ না হয় ছাত্র জনতাকে হত্যা করলো কিন্তু পুলিশ হত্যা করলো কে বা কারা? এইটুকু লেখার জন্য পত্রিকার বিরুদ্ধে তোপ দাগা একেবারেই অনুচিত।’

‘সব মিলিয়ে পত্রিকায় আমার অবস্থা তাই খুবই নাজুক। সজ্জন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক চাপ সইতে না পেরে আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করেছেন,’ বলেন বিভুরঞ্জন।

ইউনূস দু’বার লেখা পড়ে ফোন করেছেন

মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক অবস্থানের কারণে তাকে ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেওয়া হয় জানিয়ে বিভুরঞ্জন লিখেছেন, ‘কিন্তু আওয়ামী আমলেও কোনো বাস্তব পুরস্কার পাইনি। আমি পেলাম না একটি প্লট, না একটি ভালো চাকরি। বরং দীর্ঘ সময় চাকরিহীন থেকে ঋণের বোঝা বেড়েছে। স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে পরিবারের দায়বদ্ধতা আমাকে প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যে রাখে।’

“আজকের পত্রিকায়” কাজ করছি ৪ বছর হলো। এই সময়ে না হলো পদোন্নতি, না বাড়ল বেতন। অথচ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিদিন। সংবাদপত্র আর কীভাবে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে, ঘরের মধ্যেই যেখানে অনিয়ম।’

তিনি অকপটে জানান, ‘সাপ্তাহিক “যায়যায়দিন” জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যাদের লেখার কারণে তাদের একজন তারিখ ইব্রাহিম। ওই নামে আমিই লিখতাম এরশাদের কোপানল থেকে রক্ষা পেতে। ক্ষমতা ছাড়ার পর দু-একবার দেখা হলে অবশ্য এরশাদও “দেশি” হিসেবে আমাকে খাতির করেছেন।’

‘আমি চাকরি করেছি দৈনিক সংবাদে, সাপ্তাহিক একতায়, দৈনিক রূপালীতে। নিজে সম্পাদনা করেছি সাপ্তাহিক “চলতিপত্র”। নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি “মৃদুভাষণ” নামের সাপ্তাহিকে। “দৈনিক মাতৃভূমি” নামের একটি দৈনিকের সম্পাদনার দায়িত্বও আমি পালন করেছি। দেশের প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকা এবং অনলাইনে আমার লেখা একসময় নিয়মিত ছাপা হতো। দৈনিক “জনকণ্ঠ” যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন প্রথম পৃষ্ঠায় আমার লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপা হতো।’

হতাশা ছড়ায় তার বক্তব্যে, ‘অথচ এখন কোনো কোনো পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে ছাপার জন্য অনুরোধ করেও ফল পাই না। আমার লেখা নাকি পাঠক আর সেভাবে “খায়” না।’

‘এক সময় কত খ্যাতিমান লোকেরা আমার লেখা পড়ে ফোন করে তারিফ করেছেন। অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যক্ষ সাইদুর রহমানের প্রশংসাও আমি পেয়েছি। রাজনীতিবিদ অলি আহাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, লেখক অধ্যাপক শওকত ওসমান, ড. রংগলাল সেন, অধ্যাপক ড. অজয় রায়ের মতো কতজনের প্রশংসা পেয়েছি। বিএনপির এক সময়ের মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়াও আমাকে লেখার জন্য স্নেহ করতেন। ওহ হ্যাঁ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসও অন্তত দুবার নিজে আমাকে ফোন করে আমার লেখার কথা বলেছেন। এখন অবশ্য এত সাধারণ বিষয় তার মনে থাকার কথা নয়। আজ আমার লেখা নাকি পাঠক টানে না। হতেই পারে, বয়সের ভারে বুঝি লেখা হালকা হয়ে গেছে।’

গণমাধ্যম তার ‘প্রাপ্য সন্মানি’ দেয়নি জানিয়ে তিনি আরো লেখেন, ‘নামে-বেনামে হাজার হাজার লেখা লিখেছি। সম্মানি কিন্তু পেয়েছি খুবই কম। কোনো কোনো পত্রিকা তো কয়েক বছর লেখার পরও একটা টাকা দেওয়ার গরজ বোধ করেনি। সেদিক থেকে অনলাইনগুলো অনেক ভালো। একটি বড় অনলাইনের কাছেও আমার মোটা টাকা এখনো পাওনা আছে।’

‘অথচ এখন আমার দৈনন্দিন জীবন শুরু হয় ওষুধ খেয়ে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিয়ে এবং ওষুধ কেনার টাকার চিন্তায়’, উল্লেখ করেন সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার।

 

 

 

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *