হত্যা মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যদিও তিনি হত্যাকাণ্ডের বিরোধী ছিলেন। সমেছ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুর ১০ মাস পর দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মৃত্য ব্যক্তিকে ‘জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধা’ দেখানো হয়েছে মামলায়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে মাহমুদুল হককে নগরীর ধাপ ইঞ্জিনিয়ার পাড়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে আদালতে তোলা হয়।
গ্রেপ্তারের বিষয়ে হাজীরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন শাহ বলেন, ছমেস উদ্দিন হত্যা মামলায় বেরোবি শিক্ষক মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হককে হাজিরহাট থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে একটি হত্যা মামলায়। তবে সেটি আমাদের ক্যাম্পাসের নয়। বাইরের ঘটনা। আমরা বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছি।’
মাহমুদুল হককে গ্রেপ্তারের পর তার ফেসবুক আইডি থেকে একটি পোস্টে করা হয়। সেখানে বলা হয়,‘আমি মো. মাহমুদুল হকের সহধর্মিণী লিখছি, আমার হাজব্যান্ড মো. মাহমুদুল হক সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর; আজ বেলা আনুমানিক সাড়ে ৩টায় আমার রংপুরের ধাপ এলাকায় অবস্থিত নিজ বাসা থেকে রংপুর মেট্রোপলিটন হাজিরহাট থানা-পুলিশ আমার হাজব্যান্ডকে আটক করে সরাসরি আদালতে নিয়ে যায়। কোনো এক হত্যা মামলার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
‘আমার হাজব্যান্ড এ রকম কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তিনি পুরোপুরিভাবে নির্দোষ। এটি একটি পরিকল্পিতভাবে সাজানো মিথ্যা মামলা। আমি আমার হাজব্যান্ডের স্নেহভাজন শিক্ষার্থী, সম্মানিত সহকর্মী, সাংবাদিকতা পেশার সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী সবার পক্ষ থেকে সহযোগিতা কামনা করছি।’
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ২ আগস্ট তৎকালীন পুলিশ, প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ডের রাধাকৃষ্ণপুর এলাকার মুদিদোকানি ছমেস উদ্দিনকে (৬৫) তার দোকানে এসে হুমকি দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছমেস উদ্দিনকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করেন।
এতে তিনি অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে পুলিশ ও আসামিরা তাকে রেখে পালিয়ে যায়। পরে পরিবারের সদস্যরা ছমেস উদ্দিনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী আমেনা বেগম বাদী হয়ে হাজীরহাট থানায় ৩ জুন একটি মামলা করেন। এতে শিক্ষক মাহমুদুল হককে ৫৪ নম্বর আসামি করা হয়।
১৬ জুন একই মামলায় দেলওয়ার হোসেন নামে আরেক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি রাধাকৃষ্ণপুর ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ।
হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার:
মাহামুদুল হক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে লেখালেখি করেছিলেন। স্পষ্ট অবস্থান ছিল হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতায়। সে সময় তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে মারা যান রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। সেসময় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে মাহমুদুল হক লেখেন: ‘পুলিশ হত্যা করেছে সাঈদকে সন্ত্রাসীদের থেকেও ঘৃণ্যভাবে!’
এরপরই লেছেন,‘পুলিশ গুলি করলো আমার শিক্ষার্থীকে তার ক্যাম্পাসের মাটিতে দাঁড়িয়ে। একেবারে প্রবেশদ্বার ক্যাম্পাসের ভিতর থেকে। পুলিশ এ সাহস কোথা থেকে পেলো? পুলিশ কি ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি দেখাতে পারবে? অনুমতি কে দিলো? প্রবেশের অনুমতি পেলেই কি শিক্ষার্থীকে গুলি করতে পারে? সাঈদ তো বাইরে থেকে যেতে চেয়েছিল নিজের ক্যাম্পাসে, তার নীড়ে।নিশ্চয় পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করতে নয়। সে তো বহিরাগত নয়, ক্যাম্পাসটা সাঈদের, পুলিশ বহিরাগত। পুলিশ এতো কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূর থেকে টার্গেট করে কীভাবে গুলি চালালো? একটি গুলি নয়, কয়েকটি পরপর। দাঁড়িয়ে আছে সাঈদ আর গুলি চলছে। পুলিশ নির্বিচার গুলি করলো, এটা তো নির্বিচার হত্যাকাণ্ড। পুলিশ হত্যা করেছে সাঈদকে সন্ত্রাসীদের থেকেও ঘৃণ্যভাবে। কেননা, সাঈদের দুই হাত উঠানো তো শান্তির বার্তা, এভাবে হাত উঠালে সন্ত্রাসীও গুলি বন্ধ করে, অস্ত্র নিচে নামিয়ে নেয়। এটা মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশসহ যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।’
যোগ করেন,‘আমি পরাহত, আমি অনুতপ্ত এজন্য যে নিজ হাত দিয়ে ওই বন্দুকের নল চেপে ধরতে পারিনি কারণ আমি ঢাকা থেকে পথিমধ্যে ছিলাম। ক্ষমা করো আমাকে আর কবরে শুয়ে দোয়া করো আমরা তোমার শিক্ষকরা যেন জোহা স্যারের ন্যায় মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারি।’
১৮ জুলাই ফেসবুকে দেওয়া অপর এক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘পুলিশের তদন্ত মানি না, বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই’
আরও লেখেন,‘কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারকে (প্রশাসন) প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
তদন্ত কমিটি প্রত্যাখ্যান করে লেখেন,‘আমি সাঈদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে এই তদন্ত কমিটি প্রত্যাখান করছি। কারণ পুলিশের অপরাধের তদন্ত করবে পুলিশ এটা সাঈদের রক্তের সঙ্গেও প্রহসন। সাঈদকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ভিডিও দেখলেই তা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন করে পুলিশ সদস্যদের সবোর্চ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ নিজের তদন্ত নিজেই করবে-এটা হতে পারে না।’
১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পুলিশ আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। আর আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র আবু সাঈদের পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হন বহু মানুষ, যাতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।