যাত্রা শুরুর মাত্র চার মাসের মাথায় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তরুণ সংস্কারপন্থীদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দলটি কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ, দলে শৃঙ্খলাভঙ্গ, চাঁদাবাজি ও যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগের মুখে পড়েছে।
অভিযোগগুলো শুধু দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নই করেনি বরং অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা ও নৈতিক শাসনের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে এনসিপি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এর আগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে দেশে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে।
শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে একটি বিকল্প হিসেবে গণ্য হতে থাকে। কিন্তু দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক ‘কেলেঙ্কারি’ সেই আশাবাদের ওপর কালো ছায়া ফেলেছে।
দলটি এখনো নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পায়নি ও তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তুলতেও হিমশিম খাচ্ছে। যদিও দলীয় নেতারা ভবিষ্যতে এমন অনিয়ম রোধে একটি কঠোর আচরণবিধি তৈরির কথা বলছেন। বাস্তবে দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ব্যবস্থা অত্যান্ত দুর্বল এবং কিছু নেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপও কার্যকর হচ্ছে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই শুরুতেই সৃষ্টি হওয়া বিতর্কগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গভীর, কাঠামোগত সমস্যাকেই প্রতিফলিত করে।
একজন পর্যবেক্ষক বলেন, ‘সর্বময় ক্ষমতা সর্বময় দুর্নীতিকেই জন্ম দেয়–সেই পুরনো প্রবাদটাই এখানে প্রযোজ্য।’
এখন পর্যন্ত অন্তত পাঁচজন কেন্দ্রীয় নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে দলটি। এর মধ্যে তিনজন ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে সংশোধনের অঙ্গীকার করেছেন। তারা হলেন-যুগ্ম প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হান্নান মাসুদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য জুবাইরুল আলম মানিক ও জুবাইরুল হাসান আরিফ।
সাবেক যুগ্ম সদস্য সচিব এবিএম গাজী সালাউদ্দিন তানভীর এখনো দল থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত। তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের পদে নিয়োগে প্রভাব খাটানো ও এপ্রিল মাসে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর পাঠ্যবই ক্রয় চুক্তিতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে টাইমস অব বাংলাদেশ-এর সঙ্গে আলাপকালে তানভীর এসব অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন ও মিথ্যা’বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘যদি অভিযোগের সত্যতা থাকত, তাহলে মন্ত্রণালয় থেকে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই কিছু বলতেন। প্রমাণের অনুপস্থিতিই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। যদি কোনোদিন প্রমাণ আসে, আমি স্বেচ্ছায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করব।’
বিষয়টি এখন দলীয় সর্বোচ্চ ফোরামের ‘সুপার টেন’এর পর্যালোচনায় রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, ন্যায়সংগত সিদ্ধান্তই আসবে ও আমি দলের কাজে ফিরতে পারব, যোগ করেন তানভীর।
অন্যদিকে, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার দলের এক নারী সদস্যকে হয়রানির অভিযোগের মুখে পড়েছেন। তাদের মধ্যকার একটি কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
তুষারকে রোববারের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবেন। সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে তুষার দাবি করেন, অডিওটি ‘কারসাজি করা’এবং তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশে ছড়ানো হয়েছে।
পোস্টে তিনি লেখেন: ‘যে নারীকে নিয়ে বলা হচ্ছে, তিনি এনসিপির কোনো নেতা বা সদস্য নন। এটা বিদেশি চক্রান্তের অংশ, যাতে এনসিপিকে দুর্বল করা যায়।’
দলটির শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও যুগ্ম সদস্য সচিব মীর আরশাদুল হক বলেন, ‘প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব হলে সতর্ক করা হয়। কিন্তু বারবার অনিয়ম করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ কারণ দর্শানোর নোটিশ মানে হচ্ছে, দলের শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে কেউ নয়, যোগ করেন তিনি।
দলের যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায় বলেন, ‘আমরা শৃঙ্খলিত রাজনৈতিক কাঠামো গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের অনেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলে অন্তর্ভুক্ত হননি, ফলে আগে হস্তক্ষেপ করা কঠিন ছিল।’
তানভীরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত শিগগিরই আসবে। আমরা ধাপে ধাপে চলি-প্রথমে নোটিশ, তারপর প্রমাণভিত্তিক পর্যালোচনা ও সবশেষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যোগ করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, এসব বিতর্ক দলের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তারা প্রথমে একটি প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে পারত-সেটাই সম্ভবত ভালো হত, যোগ করেন তিনি।
একাধিকবার ফোন কল ও এসএমএসের মাধ্যমে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও প্রধান সমন্বয়কারী নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে টাইমস অব বাংলাদেশ। তবে তারা সাড়া দেননি।
নতুন এ দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি। অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।